ডাক্তার আর প্রভাষক সামলাছেন দোকানে খদ্দর

ডাক্তার আর প্রভাষক সামলাছেন দোকানে খদ্দর
মিষ্টির কারখানা বাড়িটাই । ঘরজুড়ে গনগনে আগুনের তাপ।সারা দিন সেখানে চুলা জ্বলে। চুলার পাশের একখানা চৌকিতে ঘুমান তিন ভাইবোন—মিতারানী পাল, মৃণালকুমার পাল ও অমিতকুমার পাল। এই বাড়িতেই বেড়ে ওঠা মিতা এখন সরকারি কর্মকর্তা, অমিত সরকারি কলেজের শিক্ষক। আর মৃণাল হয়েছেন চিকিৎসক। ছুটি পেলেই দুই ভাই বাড়ি এসে মিষ্টিদোকানি বাবার ফুটপাতের দোকানে গিয়ে বসেন। মিতা হাত লাগান কারখানার কাজে। এবার ঈদের ছুটিতে তাঁদের দুই ভাইয়ের মিষ্টির দোকানে কাজ করার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এনেছেন। শুধু তা–ই নয়, এই দোকানের মিষ্টি তিনি প্রধানমন্ত্রীকেও পাঠিয়েছেন। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী বাজারে এই তিন ভাইবোনের বাড়ি। সবার বড় মিতারানী রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৭ সালে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেছেন। গত জানুয়ারি মাসে তিনি সরকারি ওষুধ কোম্পানি এসেনশিয়াল ড্রাগসের বগুড়া কার্যালয়ে জুনিয়র অফিসার পদে যোগ দিয়েছেন। ছেলে অমিতকুমার পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করে ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন সান্তাহার সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। ১৬৪তম বিসিএস বনিয়াদি প্রশিক্ষণে দেশসেরা হয়েছেন অমিত। আরেক ছেলে মৃণালকুমার পাল একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এখন ইন্টার্নশিপ করছেন। পাশাপাশি ৪৪তম বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ১ মে আড়ানী বাজারের হাটচালিতে গিয়ে দেখা গেল, বাবা উত্তমকুমার পালের দুই পাশে দুই ছেলে বসে রীতিমতো খদ্দের সামলাচ্ছেন। ফুটপাতের ওই মিষ্টির দোকানে বসেই বাবাকে সহযোগিতার পাশাপাশি রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন মৃণাল। আড়ানী পৌর এলাকার জোতরঘু মহল্লার বাসিন্দা সুনীল আচার্য বুকের ব্যথা নিয়ে এসেছিলেন মৃণালের কাছে। সুনীল বললেন, ‘এই ছেলের হাতযশ ভালো। এ জন্য মৃণাল বাড়িতে এলেই কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে তাকে দেখাতে আসি।’ অমিতকুমার পাল জানালেন, এই দোকানে ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কাজ করে তাঁরা বড় হয়েছেন। এটা তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়। ছুটি পেলেই বাড়ি এসে দোকানে বসেন। তাঁদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে অবাক হতে হলো। পুরোটাই রীতিমতো কারখানা। চুলার গনগনে আগুনের পাশে একদিকে তিনটি চৌকি। একটি চৌকিতে তিন ভাইবোন, একটিতে তাঁদের মা–বাবা, অপর চৌকিতে দাদি ঘুমান। আগুনের আঁচে যে ঘরে অল্পক্ষণ বসে থাকাই দায়, সেখানেই বড় হয়েছেন মিতা, অমিত, মৃণাল। অমিতদের মা বাসনারানি পালের মুখে তাঁদের কষ্টের কথা শুনে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। মেয়ে কখনো চেয়েছেন ৫ হাজার টাকা, বাবা পাঠিয়েছেন ২ হাজার। ওদিকে ছেলে চান ১০ হাজার, তাঁকে কোনোরকম অর্ধেক টাকা পাঠিয়ে সামলে নিতে বলেন। বাবার কষ্ট দেখে ছেলেমেয়েরা সব মেনে নেন। এক ভাইয়ের জামা দুই ভাই মিলে পরেন। ছোটবেলায় ভালো খাবার, ভালো জামাকাপড় চাইতেন তাঁরা। বোঝার বয়স হওয়ার পর আর কখনো চাননি। বাসনারানি দেখালেন, তাঁদের শোবার ঘরের একপাশে চালা নেই। বললেন, ‘রাতের বেলায় আকাশে মেঘ দেখলেই ভগবানকে ডাকি যেন ঝড়বৃষ্টি ডান–বাম দিয়ে পার হয়ে যায়। বৃষ্টি এলে বিছানাপত্র গুছিয়ে সারা রাত বসে থাকতে হয়।’বাবা উত্তমকুমার বললেন, ‘আমার মতো এত কষ্ট করে আর কেউ ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন কি না জানি না। আমি কোনো দিন ওদের দোকানে বসতে বলিনি। ওরা নিজে থেকে বসে, এটাই আমার ভালো লাগে।’ দুই ভাইয়ের দোকানে বসার বিষয়টি প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা তৌফিকুল বারী। তিনি একটা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। বললেন, ‘অমিত আর মৃণালের মতো এত অমায়িক, ভদ্র এবং পরিশ্রমী ছেলে আর হয় না। চিকিৎসক হওয়ার পর মৃণালকে যখন যেখানে যে-ই ডাকে, ছুটে যায়। দুই ভাই-ই ভীষণ মানবিক। ওদের মা–বাবাকেও শ্রদ্ধা জানাতে হয়।’